”
(মোঃ আব্দুল খালেক খান
পাবনা)
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টিএমএসএস (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ)-এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, বিশেষ করে নারী ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে লাখো নারীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন ও সমগ্র দেশের ৬৪টি জেলায় তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছেন। তাঁর অদম্য সাহস, দূরদর্শিতা ও মানব সেবার ব্রত তাকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
টিএমএসএস’র শুরু ও ব্যাপ্তি –
১৯৮০ সালে ভিক্ষার কিছু মুষ্টির চাল জমানোর মাধ্যমে টিএমএসএস’র কার্যক্রম শুরু হয়। ভিখারিনী ফাতেমা বেওয়ার ভিক্ষার চাল জমানোর স্বপ্ন হোসনে-আরা বেগমকে অনুপ্রাণিত করে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকেই সংগঠনটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। পরবর্তীতে খিচুড়ি রান্না করে ভিক্ষুক সম্মেলন আয়োজন করা হয় ও সেই সম্মেলন থেকে ৩৭৬ জন নারী ভিক্ষুককে সংগঠিত করা হয়। বর্তমানে টিএমএসএস দেশের ৬৪টি জেলায় বিস্তৃত এবং প্রায় ৩৭ লাখ নারীকে সংগঠিত করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই সংগঠনে প্রায় ৩৫ হাজার নারী কর্মরত রয়েছেন।
সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমের নানা দিক –
অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম টিএমএসএস’র মাধ্যমে বহুমুখী সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
* ক্ষুদ্রঋণ ও নারী ক্ষমতায়ন: টিএমএসএস ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫৩ লাখ পরিবার উপকৃত হয়েছে। নারীদের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, সচেতনতা এবং সামাজিক ব্যাধি থেকে সুরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
* শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাঃ টিএমএসএস শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, স্কুল এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা শিক্ষার সুযোগ তৈরি করেছে। এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
* আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ
দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নতিতে টিএমএসএস কাজ করছে। সিএনজি ও পেট্রোল পাম্প, মার্কেট, হেলিকপ্টার সার্ভিসসহ অসংখ্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক।
* তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে একটি উপযুক্ত সমাজ গঠনের জন্যও টিএমএসএস সচেষ্ট।
* গ্রাম ও শহর উন্নয়ন: টিএমএসএস শুধু গ্রামীণ জনপদে নয়, শহরাঞ্চলেও উন্নয়নে অবদান রাখছে। বগুড়ায় ফাইভ স্টার হোটেল ‘মম ইন’ প্রতিষ্ঠা এর একটি উদাহরণ।
স্বীকৃতি ও সম্মাননাঃ
অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম তার অসামান্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘অশোকা ফেলোশিপ’ এবং ‘বেগম রোকেয়া পদক’ অর্জন করেছেন। তার কর্মময় জীবন দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত। তিনি শুধু নারী উন্নয়ন আর দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, পুরুষ ও নারী উভয়ের জীবনেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলছেন।
ভবিষ্যৎ স্বপ্নঃ
অধ্যাপিকা ড. হোসনে-আরা বেগম দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে টিএমএসএস কমপ্লেক্স নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, যেখান থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা হবে। তার লক্ষ্য হলো সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো যেন এই সেবা গ্রহণ করে মানসম্মত জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে এবং বাংলাদেশ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরমুক্ত হয়।
উপসংহার:
অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম এক স্বপ্নবাজ ও সংগ্রামী নারী, যিনি নিজের ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রার মাধ্যমে লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত টিএমএসএস বাংলাদেশের উন্নয়নে এক অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে। তার জীবন ও কর্ম আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
মন্তব্য