এ কে খান
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে টিএমএসএস একটি সুপরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ নাম। নারী-নেতৃত্বাধীন এই সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সংস্থাটি নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সম্প্রসারণ, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে। বগুড়া জেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, ১৯৮০ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক ও আনসার -ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালক প্রফেসর ড. হোসনে-আরা বেগমের দূরদর্শী নেতৃত্বে সংস্থাটি নতুন করে পুনর্গঠিত হওয়ার পাশাপাশি কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ব্যাপক সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রম টিএমএসএস তাদের বহুমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবন যাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : টিএমএসএস মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে। ‘বুনিয়াদ’, ‘জাগরণ’, ‘সাহস’ ও ‘উজ্জীবিত’-এর মতো সফল কর্মসূচির মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৯.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে উপকৃত হয়েছেন। পরোক্ষ ভাবে প্রায় ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন যাত্রায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে টিএমএসএসের প্রতিশ্রুতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উন্নয়নঃ
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সংস্থাটি বিভিন্ন কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ‘ভিজিডি’ কর্মসূচির পাশাপাশি নারীদের জন্য কৃষি উন্নয়ন, উন্নতমানের বীজ বিতরণ, মধু, শাক সবজি চাষ, মৎস্য চাষ ও বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলো প্রায় ২.৩ মিলিয়নেরও বেশি পরিবারকে সহায়তা প্রদান করেছে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সচ্ছলতা আসার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাঃ
স্বাস্থ্য খাতে টিএমএসএসের অবদান অনস্বীকার্য। এর মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক ১ হাজার শয্যা বিশিষ্ট টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রাফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতাল, মাসুদা মাতৃসদন হাসপাতাল, টিএমএসএস ডায়াবেটিক কেয়ার, অটিজম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রমুখ। এছাড়াও সারা দেশে ৯৬টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র, ফার্মেসি ও একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজও সংস্থাটি পরিচালনা করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২.৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সংস্থার স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণঃ
টিএমএসএস শিক্ষা খাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ, পেশাগত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে অবদান রাখছে। অটিজম স্কুল, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ সারা দেশে প্রায় ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমে যুবকদের শিক্ষা সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ সংস্থাটি তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে ও গুণগত মান উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বাজেট ও নতুন উদ্যোগঃ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সংস্থার বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রায় ১৪ হাজার ৬ শত ৬৫ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদিত হয়েছে। এই বিশাল বাজেট স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের পথ খুলে দেবে। সংস্থাটি বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ডোমেস্টিক সেলস এন্ড পারচেজ কুপন চালু, ডিসিপ্লিন স্পেশাল ব্রাঞ্চ স্থাপন, ভলান্টিয়ার ফাউন্ডেশন গঠন, ডেডিকেটেড ডেব্ট রিকভারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা, গ্লোবাল ল ডিভিশন চালু ও লাইফ টাইম মেম্বার ইনক্লুশন প্রমুখ।
স্বাস্থ্য খাতে আধুনিকায়নঃ
স্বাস্থ্যসেবাকে আরও উন্নত করতে সংস্থাটি আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার সেন্টার ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন সুবিধার আধুনিকীকরণ, পুন্ড্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ও বিসিএল ফ্লাইং একাডেমি প্রতিষ্ঠা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা SDGs অর্জনে টিএমএসএসের অবদান
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা SDGs অর্জনে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সংস্থাটির বিভিন্ন কর্মসূচী সরাসরি SDG-১ দারিদ্র্য দূরীকরণ, SDG-২ খাদ্য নিরাপত্তা, SDG-৩ সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, SDG-৪ গুণগত শিক্ষা, SDG-৫ জেন্ডার সমতা, SDG-৬ সুপ্রিয় পানি ও স্যানিটেশন, SDG-১০ অসাম্যতা হ্রাস ও SDG-১৩ জলবায়ু কার্যক্রম অর্জনে সহায়ক হচ্ছে।
উপসংহারঃ
বগুড়ার কৃতি সন্তান, দেশের সমাজ পরিবর্তন ও নারী উন্নয়নের অগ্রদূত, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপিকা ডক্টর হোসনে-আরা বেগম প্রতিষ্ঠিত শীর্ষ পর্যায়ের ও আন্তর্জাতিক মানের বে-সরকারি উন্নয়ন সংস্থা টিএমএসএস নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি অগ্রণী উন্নয়ন সংস্থা, যা নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ সুরক্ষায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উদ্যোগগুলো দেশের সার্বিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। টিএমএসএসের এই প্রচেষ্টা একটি সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনে নিরন্তর সহায়ক হয়ে থাকবে।
মন্তব্য