কলনেঃ এস এম মনিরুজ্জামান আকাশ)
আমি কখনো ভাবিনি ক্যাডার হবো। আমার স্বপ্ন ছিলো আবহাওয়াবিদ হবো বা জাতিসংঘে কাজ করবো ….
৩০ তম বিসিএস এর সার্কুলার হলো । ফর্ম তোলার প্রশ্নই উঠে না, কারন কখনোই এই চিন্তা আসেনি, জীবনে একটা কারেন্ট আ্যফেয়ার্স ও পড়িনী।
তখন মাত্রই ঢাকা এসেছি । খুব খুব কাছের একজন মানুষের বান্ধবীর সাথে এক রুমে উঠলাম । আপু একদিন এসে বলল..” পাপড়ি, আমার ২ টা ফর্ম কেনা হয়ে গেছে । বন্ধুরা একটা কিনছে, আবার বয়ফ্রেন্ড ও একটা কিনছে । তুমি প্লিজ একটা নাও, নাহলে ৫০০ টাকা নষ্ট হবে আমার । রুম মেটের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার প্রত্যয়ে ফর্ম টা নিলাম । আর জমা দেই না । একদিন মলচত্বরে বসে আছি, মাসুদ ভাই ( ৩১ এর আ্যডমিন ) বললেন ফর্ম জমা দিবা না । আমি বললাম , না ভাইয়া, এগুলো আমি বুঝিনা। ভাইয়া বললেন, যাও ফর্ম টা নিয়ে আসো । ফর্ম আনতে আনতে
মাগরিবের আযান দিলো! ভাইয়ার একটা চাইনীজ ফোন ছিলো, ভাইয়া ওটার টর্চ জ্বালিয়ে নিজেই ফর্ম পুর্ন করে দিলেন । আমারে চয়েস লিষ্ট জিজ্ঞেস করলে, বললাম বিদেশের কি আছে ? সে বলল, ফরেন ক্যাডার। আমি বললাম সেটাই দেন, বাকিগুলো মাসুদ ভাই বসালো। আমি আর জমা দিতে যাই না।বন্ধু রুবেল একেবারে শেষ দিন ফর্ম জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করলো।
প্রিলি পরীক্ষা, মে, ২০১০
কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। তখন রুমমেট ছিলো শিশির আর Asma Sarwar Anu । অনু খুব ভোরে উঠে রান্না করলো। শিশির চা বানালো। পুরনো ঢাকার ভেতর একটা হলেই সিট পড়েছিল। আমি এভারেজ পরীক্ষা দিলাম।
প্রিলির রেজাল্ট হল অক্টোবরে,২০১০।
আমি খুলনা তে।
পাশ করার প্রশ্নই উঠে না।তাই চেক ও করলাম না। কিন্তু অনেকেই ফোন করাতে ভাবলাম দেখি। হায় কপাল, admit card আর খুজে পাই না। কোনো ফাইল এ নেই, কোনো ড্রয়ারে নেই, কোথাও নেই। রোল নাম্বার তো মনেই নেই। পরে শিশির আর অনু আমার কাগজ ফেলার বিন থেকে ( ৫ ঘন্টা প্রায়) সেটা উদ্ধার করলো। এবং আমার কৃতকার্যের তথ্য দিলো।
এই খুশি আমি কোথায় রাখি??
রিটেন পরীক্ষা জানুয়ারির ১১ তারিখ, ২০১১।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ, আমি গেলাম। তখন আবার বাসায় কাজ চলতেছে। মা বলল, তুই ২ দিন বাড়ি থেকে যা, মিস্ত্রির এত ঝামেলা, আমি একা পারতেছি না। আমি থেকে গেলাম। মাসুদ ভাই বারবার ঢাকা ফিরতে বলছিলেন।
ঢাকা ফিরলাম ৭ ই জানুয়ারি। মাসুদ ভাই আমাকে দেখে বেহুশ হবার অবস্থা। সে বলল, পাপড়ি সব শেষ করে ঢাকা ফিরছো? এই ২ দিন আর কি পড়বা? তুমি আসলে বোঝোইনি, বিসিএস এ প্রিলি পাশ করা কত বড় ব্যাপার! তারপর সব বই নিয়ে বসলাম মলচত্বর, আবার তার সাথে। সে পড়ে আমি শুনি।
পরীক্ষা শুরু হলো জানুয়ারির ১১ তারিখেই, খুব ঠান্ডার ভেতর। তখন আমার অন্য বাসা। ভাগ্য আমার সাথে। নতুন রুমমেট বা বড় বোন sarmin Sharmin Lima! শীতের ভেতর পরীক্ষা দিয়ে এসেই দেখতাম সে পানি গরম করে রেখেছে। আমি গোসল করে বসতেই সে খাইয়ে দিতো। আমার চোখে পানি চলে আসছে, সেই দিন গুলোর কথা মনে করতে। খুব ছোটো রুম, হাটাও যায় না ঠিক ভাবে। সেই রুমেই পিনড্রপ সাইলেন্স করে সে আমাকে ঘুমাতে পাঠাতো। ঘুম থেকে উঠেই মাসুদ ভাইয়ের কাছে যেতাম। ভাইয়া বলতো, আমি শুধু শুনতাম। অন্য রুমমেট Shamima Akter আপুর প্রস্তুতি খুব ভালো ছিলো। তার আর আমার সিট ও পড়েছিল এক জায়গায়( আলিয়া মাদ্রাসা), সেও অনেক সাহায্য করেছে।
২রা জুন, ২০১১।
রিটেনের রেজাল্ট হলো। আমি পাশ করলাম। ২০ শে জুন থেকে ভাইভা শুরু, আমার টা ২৮ তারিখ। এবার আমি প্রানপন চেস্টা শুরু করলাম। ভাগ্য দূরে সরতে লাগলো। আবারও নতুন রুমমেট। সে আমাকে ফেল করানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলো। যখন পড়তে বসি, সে খুব জোরে জোরে পড়া শুরু করে। ঘুমালে খুব শব্দ করে। জীবন বিষ বানায় দিলো পুরা। এদিকে ভাইভা ২৮ তারিখ। বটগাছের মতো শক্তি নিয়ে পাশে দাড়ালো Moumita Hossain. তবুও শুধু ঘুমানোর জন্য আমাকে বাসা ছাড়তে হলো। যে বাসায় ছিলাম, আন্টি ও অনেক সহযোগিতার চেষ্টা করছে, কিন্তু রুমমেটের হাত থেকে আমাকে বাচাতে পারেনি। মা খুলনা থেকে আসলো। আমি মার সাথে হোটেলে একটা রুমে উঠলাম, সেখান থেকেই ভাইভা দিয়েছিলাম।
২৮ জুন, ২০১১
আমার ভাইভা। বাবা গেছেন সিএনজি ডাকতে। আমরা রুমে। আমি খাটের উপর উঠে শাড়ি পড়ছি। হাত উচু করতেই ফ্যান এত সাথে হাত লেগে ডান হাতের মাঝের আংগুল খুব injured হলো। আমি হাত চেপে বসে পড়লাম।মা চিতকার করে কাদছে।বাবা দৌড়ায় আসছে, এরপর ডাক্তার এর কাছে যেয়ে হাতে ব্যান্ডেজ তারপর পিএসসি। ইনজুরির পর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ভয় কাতুরে আমার সব ভয় একসাথে উধাও হয়ে গেলো। আমি ভাগ্যের হাতে সব ছেড়ে খুব রিল্যাক্স এ ভাইভা দিলাম। এবং ভাইভা শেষে আমার মনে হলো, কিছু একটা হবে।
২রা নভেম্বর,২০১১
আমি খাগড়াছড়িতে একটা রিসার্চ এ। বাবার ফোন, “””৩০ তম বিসিএস এর রেজাল্ট হয়েছে”””। আমি কাদছি আর কাদছি। মামুন ভাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তে শত শত মানুষ ওই পাহাড়ি অজ পাড়াগায়ে এসে উৎসব এর পরিবেশ বানিয়ে দিলো। Lopa Talukder ( ইমু বাবু নাটকের নায়িকা) আন্টির বাসায় থাকি, আংকেল কে বাবা বলতাম ( সে নেই, কয়েক দিন আগে খাগড়াছড়ি গিয়েছিলাম, অনেক কস্টে যখন বাসা খুঁজে পেলাম, তখন শুনলাম সে আর নেই পৃথিবীতে)! আংকেল যে কতো আয়োজন করলো, একেবারে নিজের মেয়ের মতো। অতি আবেগপ্রবণ আমি, তখনও কেদেই যাচ্ছি!
আমার একটাই চাকরির আবেদন
একটাই চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
সেই চাকরি
৩০ তম বিসিএস এর পুলিশ ক্যাডার।
সোহেল রানা রতন ভাই, আপনার কথা লেখার ক্ষমতা এই অধমের নেই।
২রা ফেব্রুয়ারি,২০১২ তে মেডিকেল হলো।
মে, ২০১২ তে গেজেট।
৩রা জুন,২০১২ তে হোম মিনিস্ট্রি তে যোগদ সেদিন, মাঝে চলে গেছে এক দশক।
অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে, আবার লিখবো পরে।
তবে আমার মনে হয়….
* বিসিএস এর প্রস্তুতি ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু হয়।
ব্যসিক টা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কখনো সাজেশন পড়তাম না।পুরো বই পড়তাম। হয়তো marks কম পেতাম।
* রিজিক আল্লাহ নির্ধারন করে রেখেছেন।
আপনি জানেন না কোথায় সেটা আছে! তাই সবসময় তার উপর বিশ্বাস অবিচল রাখতে হবে।
He is the architect of ur life.
আমি মাঝারি মেধার। পরিশ্রমি ছিলাম সব সময়। মনে প্রানে বিশ্বাস করি কোনো শ্রম বৃথা যায় না……
লেখকঃ
কানিজ ফাতেমা পাঁপড়ি
অপরাধ সংগঠন, ফরেনসিক এন্ড টেরর ফাইনান্সিং উইং,
এন্ট্রি টেরিজম ইউনিট, বাংলাদেশ পুলিশ।
ও
৩০তম ন্বিসিএস ক্যাডার(পুলিশ)।
মন্তব্য